বুক রিভিউ ও পিডিএফ - কারাগারের রাতদিন।

 


লেখিকা- জয়নব আল-গাজালী।

প্রকাশনী- প্রফেসর'স পাবলিকেশন্স।

                            -----------------

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে যে কজন নারী ইসলামী আন্দোলন সংগ্রাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে জয়নব আল গাজালী আল জুবায়লি নাম থাকবে সবার শীর্ষে,

আমরা জানি যে বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে মুসলিম বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাইয়েদ কুতুব পরিবার সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে, সাইয়েদ কুতুব তো মিশরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল থাকার অপরাধে জামাল আবদেল নাসের সরকার কর্তৃক শাহাদাত বরন করেন।তাঁর বোন হামীদা কুতুব, আমীনা কুতুব উভয়েই নাসের সরকার কর্তৃক জেল জুলুম সহ নানা নির্যাতনের স্বীকার হোন।

আর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে নারীর নাম আসবে তিনি অবশ্যই "মরিয়ম জামিলা"..।।


জয়নব আল গাজালীর পরিচয়---

জয়নব আল গাজালী আল জুবায়লি ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারী মিশরের বিহারা প্রদেশের মাইতিন গ্রামে জন্মগ্রহন করেন, মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে জয়নাব আল গাজালী ‘জমিয়াত আল সাইয়্যেদাত আল মুসলিমাত’ (মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশন) নামে সংগঠন গঠন করেন।

১৯৪৮ সালে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মহিলা শাখায় যোগদান করেন।

১৯৬৫ সালের ২০ আগস্ট জামাল আবদেল নাসের সরকার জয়নব আল গাজালীকে গ্রেফতার, তাকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়,

১৯৭০ সালে জামাল নাসের মৃত্যুবরণ করলে ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন,

২০০৫ সালের ৩ আগস্ট মহিয়সী সংগ্রামী মহান নারী জয়নব আল গাজালী ইন্তেকাল করেন।


কারাগারের রাতদিন--------

কারাগারের রাতদিন বইটিতে জয়নব আল গাজালী তার ৬ বছরের জেল জীবনের করুন কাহিনী তুলে ধরেছেন,

১৯৬৫ সালের ২০ আগস্ট তাকে গ্রেফতার করে নাসেরের নির্দেশে সামরিক কারাগারে পাঠানো হয়।


এ বিষয়ে জয়নব নিজেই বলেন-- 'সামরিক কারাগারে আমাকে নিয়ে যাবার পর এক কৃষ্ণকায় ব্যক্তি তীব্র রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে- 

তুই কে..? আমি ধীর শান্তভাবে জবাব দিলাম-

:জয়নব আল গাজালী আল জুবায়লি....।।আমার এতটুকু কথা..!! 

শুনতে না শুনতেই সে তার বিভৎস বিকৃত মুখে এমনভাবে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিল যে, জীবনে এমন কদর্য্য ভাষা আমি কোনদিন শুনিনি।'

তিনি আরও বলেন- ' যে জল্লাদ আমাকে নিয়ে কারাগারে ঘুরে ফিরছিল, সে আমাকে আল্লাহর দরবারে দোয়াবাক্য উচ্চারণ করতে শুনে তার প্রকাণ্ড ভারী দুহাত উপরে তুলে প্রচণ্ড জোরে আমার কানপট্রির উপর মুষ্টাঘাত হানে।আঘাতের তীব্রতায় আমি বধির হয়ে পড়ি এবং কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়ে যায়, মনে হচ্ছিল যেন আকস্মিক বজ্রপাতে হতভম্ব হয়ে পড়েছি।'


তারপর তাকে জেলের ২৪ নং সেলে নিয়ে যাওয়া হয়,

এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন-- 'আমি দেখলাম পুরো কক্ষটি কুকুরে ভরা...আমি এত সব কুকুর দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম।আমার সারা শরীর জুড়ে অসংখ্য কুকুরের অসহ্য দংশন চলছিল।মাথা,হাত,ছাতি,পিঠ পা মোটকথা সর্বএ কুকুরের কামড়ে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।'


জয়নব আল গাজালীকে জেলে মধ্যযুগীয় কায়দায় কঠিন নির্যাতন করা হয়, কখনো তার উপর কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়,

তাকে না খাইয়ে রাখা হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ,

মিথ্যা স্বাক্ষ্য না দেয়ায় তাকে বারবার চাবুক মারা হয় সারা শরীর জুড়ে, তাকে উলটো লটকিয়ে একসাথে ৫০০ চাবুক মারা হয়, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়,

তারপর আবার হাসপাতাল থেকে বের করে তাকে আবারও উলটো লটকিয়ে শত শত চাবুক মারা হয়,

চাবুকের কঠিন আঘাতে জয়নব আল গাজালীর সারা শরীর বেয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে, 

তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন,

তাকে প্রতিদিন বারবার চাবুক মারা হত,উপর থেকে  লাথি মেরে নিচে ফেলে দেওয়া হয়,

হাটু সমান পানিতে পরিপূর্ণ কারাগারে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফেলে রাখা হয়,

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-- 'আমি পুরো তিনটি দিন এভাবে একাকী কিছু না খেয়ে পানির সে'লে আকণ্ঠ ডুবন্ত অবস্থায় আটক থাকি।'


তাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পেশাব পায়খানা করার সামান্য সুযোগও দেয়া হত না।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-- ' আমি টানা ৬ দিন একই কক্ষে আবদ্ধ থাকি এর মধ্যে একটি বারও কক্ষের দরজা খোলা হয়নি,একফোঁটা পানি কিংবা কোন রকমের খাদ্য দেয়া হয়নি.......পানাহার নাইবা হলো, কিন্তু মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকে কেউ কিভাবে অস্বীকার করতে পারে...।'


এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর জয়নবকে কারাগারে নিষ্ঠুর নির্দয় নির্যাতন চালানো হয়,তাকে ধর্ষণের চেষ্টা পর্যস্ত চালানো হয়, কিন্তু আল্লাহ মেহেরবানিতে তারা তাতে সফল হতে পারেনি।

এরপরও তিনি দমে যাননি, শত অত্যাচার নির্যাতনেও তিনি আল্লাহ তাআলাকে ভূলে যাননি, সবসময় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থেকেছেন,

জেলের ভিতরেই তিনি প্রায় ৪ বার স্বপ্নযোগে রাসূল (সঃ) কে দেখেছেন।

জেলে জয়নব আল গাজলীর সাথে সাইয়েদ কুতুব সহ অন্যান্য ইখওয়ান নেতা কর্মীদের দেখা হয়,

জয়নব সামরিক কারাগারে থাকা অবস্থায়ই মহান নেতা সাইয়েদ কুতুবকে ১৯৬৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়,

এ প্রসঙ্গে জয়নব আল গাজালী বলেন-- 'কয়েকদিন পর সাইয়েদ কুতুব, আবদুল ফাওাহ ইসমাইল ও মোহাম্মদ হাওয়াশের শাহাদাতের খবর শুনি.......এরা প্রত্যকেই ছিলেন জাতীয় নেতা।তাদের প্রজ্ঞা,দূরদর্শিতা,উন্নত চরিত্র, মহানুভবতা, বিপ্লবী চিন্তাধারা এবং ইসলামী বৈশিষ্ট্যের জন্য গোটা জাতির কাছে এরা ছিলেন আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র।' 


মিথ্যা বানোয়াট ও প্রহসনের বিচারে জয়নব আল গাজালীকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

তিনি জেলে থাকতেই তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পান।

অতঃপর জয়নব আল গাজালী ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পান।।


বইটি কেন ও কাদের পড়া উচিত--------

প্রত্যেক মুসলিম নর নারীর জয়নব আল গাজালীর " কারাগারের রাতদিন" বইটি পড়া উচিত।

ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে, মিশরের ফেরাউন জামাল আবদেল নাসেরের নৃশংসতা নির্মমতা ও বর্বরতার করুণ কাহিনী জানতে চাইলে বইটি অবশ্যই পাঠ্য তালিকায় থাকা উচিত।

একজন নারীর উপর জালিম শাসক কি নির্মম নিকৃষ্ট নির্যাতন চালাতে পারে তার ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য হয়ে থাকবে "কারাগারের রাতদিন" বইটি।


পরিশেষে বলব, জয়নব আল গাজালী পৃথিবীতে ক্ষনজন্মা এক অবিস্মরণীয় মুসলিম নারী, যিনি তাঁর যৌবন বার্ধক্যের সব সোনালী সময়টুকুই ইসলামের তরে কাটিয়ে দিয়েছেন।তাঁর করুন কাহিনী পড়লে ইসলামের প্রথম যুগের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে অসংখ্য নারী সাহাবী মুশরিকদের দ্বারা কঠিন নির্যাতনের শিকার হন।


মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন আমাদের আরো অগণিত জয়নব আল গাজালী দান করেন।

আমাদের মুসলিম নারীরা যেন জয়নব আল গাজালীর আর্দশে জীবন কাটাতে পারে আল্লাহ তাআলা সেই তওফিক দান করুন।


নিশ্চয়ই জয়নব আল গাজালী আর জুবায়লি আছেন জান্নাতে।।।।

ডাওনলোড

Previous Post Next Post