বই রিভিউঃ- ওঙ্কার

 'ওঙ্কার' উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম আমরা জনি না। না জানলেও সমস্যা নেই কোনো। আসলে কে যে এই উপন্যাসের মূল চরিত্র সেটা বোঝা মুশকিল। হয়তো কোনো মূল চরিত্রই নেই এখানে। কোনো ব্যক্তি নয়, হয়তো বা ঘটনাপ্রবাহ কিংবা একটা নির্দিষ্ট কাল অথবা গণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাই মূল চরিত্র।


যার বয়ানে এই উপন্যাসে প্রবেশ করি আমরা, সে এক নির্জীব এবং অ-ক্রিয়াশীল মানুষ। কোনো কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার, সক্রিয় করার মতো মানসিক দৃঢ়তা কিংবা মেরুদণ্ডের শক্ত হাড়, কোনোটাই নেই তার। নিজের বাবাকে পবিত্র পশু বলা ছাড়া আর কোনো শক্তিশালী বয়ান তার কাছ থেকে আমরা পাই না। তবে, পবিত্র পশু বললেও, বাবার মানসিক উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করার কোন প্রচেষ্টা আমরা দেখি না তার মধ্যে।


তার বাবা ছিলো ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদের সর্বশেষ প্রতিনিধি। চিড়িয়াখানায় খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ। গাছপালা দেখলে অন্তরিন সিংহ যেমন স্বপ্ন দেখে গহন বন, নিবিড় অরণ্যানী আর নিষ্ঠুরতার, তার বাবাও তেমনি অতীতের প্রবল পরাক্রমশালী পূর্বপুরুষদের স্মৃতিকে জীবন্ত করে তাদের সাথে হৃদয়ের ভাব বিনিময় করতেন। সামান্য কিছু জমিজিরাত তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। সেটা নিয়েই খোঁচাখুঁচি করে বিক্রম প্রকাশ করতেন। রক্তের মধ্যে হিংস্রতার যে দহন, সেই দহন এই দংশনে কিছুটা হলেও প্রশমিত হতো। পূর্বপুরুষদের মতো খুনজখম বাধিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো তাঁর সাধ্যের বাইরে ছিলো। সেটা সাধ্যের মধ্যে ছিলো না বলে মামলা মোকদ্দমা করেই মনের ঝাল মেটাতেন। এই মামলা মোকদ্দমাতে হয়তো মনের ঝাল মিটতো, শ্বাদন্তের শান্তি হতো, কিন্তু চলে গিয়েছিলেন সর্বনাশের শেষ প্রান্তে। সব সহায় সম্পত্তি চলে যেতে থাকে তাঁকে সাহায্যকারী আবুনসর মোক্তারের দখলে।


দেনার দায়ে যখন সব সম্পত্তি আবু নসর মোক্তারের কাছে চলে যায় তখন ভিটেমাটি থেক উচ্ছেদ হবারই কথা। কিন্তু তার বদলে আবুনসর মোক্তার অদ্ভুত এক প্রস্তাব নিয়ে আসে। তার বোবা মেয়ের সাথে উপন্যাসের এই অ-ক্রিয়াশীল কথকের সাথে বিয়ে দিতে হবে। 


আগেই বলেছি এই চরিত্রের মানসিক দৃঢ়তা নেই, স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার সামর্থ্য নেই। ফলে, এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। আবুনসর মোক্তারের বোবা মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকায় থিতু হয়। শ্বশুরের সুনিপুণ হস্তক্ষেপে  তার সৌভাগ্যেরও ভাগীদার হতে থাকে।


তার বাবাদের জমিদারির কাল সমাপ্ত হলেও শ্বশুর আবুনসর মোক্তারদের আরেক যুগের সূত্রপাত ঘটে। আইয়ুব খান তাঁর সৈন্য সামন্ত নিয়ে দেশে গেড়ে বসে। সংবাদপত্রের ব্যানারে তাঁর এক জোড়া গোঁফ হুংকার দিয়ে জেগে থাকে। আবুনসর মোক্তারদের মতো ন্যায়নীতিহীন উঠতি ধনীরা অন্ধকার থেকে উঠে এসে ভিড় করতে থাকে সেই গোঁফের চারপাশে আরো ধনী হবার প্রত্যাশায়। একদিন যারা শেয়াল ছিলো, তাদের চেহারাতেও জেগে ওঠতে থাকে সিংহের আকৃতি। 


এমন লোকের জামাই হয়ে অপ্রাপ্তির কিছু ছিলো না, বরং প্রাপ্তিই ছিলো বেশি। একমাত্র অপ্রাপ্তি হচ্ছে বোবা স্ত্রীর সাথে সংসার করা। সেটকে মেনে নিয়েই দিন কাটাচ্ছিলো সে। এর মধ্যে ছোট বোনটার গান শেখার ব্যবস্থা করেছিলো। সেটা করতে গিয়েই অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করে সে। তার ছোটবোন যখন গান গায়, আড়াল থকে তার স্ত্রী সেটা অনুকরণের চেষ্টা করে। স্বরযন্ত্র কার্যকর নয় বলে সেই প্রচেষ্টা কোনো কর্মফল বয়ে আনে না বটে। তবে, স্ত্রীর এই প্রচেষ্টা দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ে সে। এতদিন যাকে বোবা ভেবে, বোধবুদ্ধিহীন ভেবে অবহেলা করেছে, তাকেই নতুন চোখে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে সে। বাক-শক্তিহীন এই নারীটি তার এই দশাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি। তার শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করছে। 


খান সাহেবের হিংস্র গোঁফ আর তার গোমড়া মুখো সৈন্যদের বুট জুতোর আঘাতে একদিন যারা ভয়ে বোবা হয়ে ছিলো, তারাও তাদের বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একদিন আঘাতের ফলে যেখানে ক্ষত তৈরি হতো, এখন সেখান থেকে যন্ত্রণার আওয়াজ বের হতে থাকে। এক যুগ লাথি খেয়ে ব্যথা জর্জর অংশটা ডাঁটো হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। যন্ত্রণা, বেদনা এবং দুঃখের কারখানা থেকে প্রতিরোধের শানানো আওয়াজ ফেটে পড়তে থাকে। সারাদেশে ঢল নাম,  পথে ঘাটে শুধু মানুষ আর মানুষ। চন্দ্রকোটালের জোয়ারের জলের মতো মানুষ ভেসে আসতে থাকে। তাদের চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কণ্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি। মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যেতে থাকে রাজপথ।  শ্লোগানের ধ্বনি বাংলাদেশের আকাশমণ্ডলে কোটি কোটি বর্শাফলার মতো খেলা করতে থাকে।


এই মিছিল বোবা মেয়েটিকে নাড়িয়ে দেয়। মিছিলের ঘ্রাণ পেলেই সে দরজা জানালা হাট করে খুলে রাখে। দ্রুত পায়ে মিছিল আসে, দ্রুত পায়ে তা চলে যায়। তার প্রতিক্রিয়ায় বোবা মেয়েটির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে, তার চোখ জোড়া ঝিকমিকিয়ে ওঠে, দু হাতে শক্ত করে জানালার শিকগুলোকে আঁকড়ে ধরে সে নিজেও শব্দারণ্যের দিকে ছুড়ে দিতে থাকে অবোধ্য শব্দরাশি, আদিম এক অব্যক্ত ধ্বনি, ওঙ্কার।


এই অব্যক্ত ধ্বনিই একদিন বাঙময় হয়ে ওঠে। তার স্বামী বুঝতে পারে গো গো শব্দ করে আসলে তার বোবা বউ বাংলাদেশের কথা বলতে চাচ্ছে। স্বরযন্ত্রের সীমাবদ্ধতায় তার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের শিরা উপশিরায় যে প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে, যে প্রবল প্রাণাবেগে কাঁপছে আকাশ, বাতাস নদী-নালা আর মানুষ,  তার প্রবল আঘাত এসে পড়েছে তার বোবা বৌয়ের মাঝেও। একদিন পরিষ্কারভাবে বাঙলা উচ্চারণ করে সে। প্রবল পরিশ্রমে গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে তার। সংজ্ঞা হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যায় সে। 


কার রক্ত বেশি লাল, এই বোবা মেয়েটির, নাকি শহীদ আসাদের, সেই প্রশ্ন রেখে শেষ হয় এই উপন্যাস।


ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন নিয়ে লেখা আহমদ ছফার এই 'ওঙ্কার' উপন্যাসটি অন্যতম সেরা একটি উপন্যাস। উপন্যাসটির আকার খুবই ছোট। সামান্য তিন ফর্মার উপন্যাস এটা। কিন্তু, এর ব্যাপ্তি অনেক বেশি বিস্তৃত। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলো। এই সময়েই বাঙালি অনুভব করেছিলো পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে তাদের আর থাকার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রয়োজন নিজেদের জন্য একটা আলাদা দেশের। আমরা একাত্তর নিয়ে প্রচুর লেখালিখি করি, কিন্তু ঊনসত্তর নিয়ে সেই পরিমাণ আলোচনা কিংবা লেখালেখি নেই। অথচ এই প্লাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিলো।


আগেই বলেছি এটা খুবই ছোট আকৃতির উপন্যাস। সামান্য কয়েকটা চরিত্র দিয়ে এর কাহিনি বুনন করা হয়েছে। যদিও এটাকে কাহিনি উপন্যাস বলার আসলে কোনো উপায় নেই। এই ছোট্ট উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে আহমদ ছফা আসলে ওই সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টায় তিনি সফল। এটা একটা রূপক উপন্যাস। উপন্যাসের বোবা মেয়েটিই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণ, পাকিস্তানি সেনাদের বুটের নীচে চাপা পড়ে একসময় হারিয়েছিলো তাদের জবান। কিন্তু, মিছিলে মিছিলে প্রবল প্রত্যয়ে শব্দ নিক্ষেপ করে সেই জবান ফিরে পেতে চেয়েছে তারা।


যে ধরনের সমৃদ্ধ এবং কাব্যময় ভাষা তিনি এই উপন্যাসের জন্য ব্যবহার করেছেন, সেটা অকল্পনীয় এবং অচিন্তনীয়। এই উপন্যাস পড়ার সময়ে কাব্যগ্রন্থ পড়ার গভীর আনন্দ পাঠককে অন্য এক ভুবনে নিয়ে যাবে। মিছিলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটা দিয়ে একটা উদাহরণ দিচ্ছি আমি। তিনি লিখেছেন, “মিছিলেরও দেখবার মতো একটি নয়ন ভুলানো সৌন্দর্য আছে। আছে তাতে গতির দোলা, ছন্দের দ্যোতনা। প্রতিটি মানুষ সমগ্র মিছিলের কাঠামোর সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হলেও তারা সকলে আলাদা আলাদা মানুষ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সচেতন সবাক চলিষ্ণু ঝরনা। একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে রচনা করেছে এই গতিমান স্রোতোধারা। লক্ষ প্রাণ ঐক্যের মন্ত্রে একসঙ্গে বাধা পড়েছে। এমনি লক্ষ লক্ষ ঝরনা প্রবল প্রাণতরঙ্গে নেচে নেচে একসঙ্গে উঠেছে। মনে হল মিছিল ভয়ংকর, আবার মিছিল সুন্দর। মিছিলে ধ্বনিত হয় ভাঙনের ধ্বংস নাদ, মিছিলে জাগে নবসৃষ্টির মহীয়ান সঙ্গীত।"


ভাষা আন্দোলন নিয়ে যেমন ছোট্ট কিন্তু অসাধারণ এক উপন্যাস হচ্ছে জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন', তেমনি ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন নিয়ে আহমদ ছফার এই ছন্দময় কাজ 'ওঙ্কার'। 'আরেক ফাল্গুন' শেষ হয়েছিলো 'আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো' এই প্রত্যয় নিয়ে, আরে এই উপন্যাস শেষ হয়েছে কার রক্ত বেশি লাল সেই জিজ্ঞাসা দিয়ে।

Previous Post Next Post